মনের যত কথা

চতুর্বর্ণ সনাতন ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।সংস্কৃত অভিধান নিরুক্ত অনুসারে, বর্ণ কথাটি এসেছে ‘বৃ’ ধাতু হতে(“বর্ণো বৃণোতেঃ” -নিরুক্ত ২/১৩)। অর্থাৎ যেই ব‍্যাক্তি যে-কর্মকে বরণ করে নেয় তা তার বর্ণ (“ব্রতমিতি কর্ম্মনাম বৃণোতীতি সতঃ”- নিরুক্ত ২/১৩)। আর চতুর্বর্ণ মানে চারটি বর্ণ – ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র।

অনেকে প্রশ্ন করেন, সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান কি চতুর্বর্ণ জন্ম অনুসারে সমাজে প্রচলন করেছেন, নাকি গুন ও কর্ম অনুসারে? আসুন এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা সনাতনী শাস্ত্রের শরনাগত হই।এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন..

“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।

তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।”

[ভগবান শ্রীকৃষ্ণঃ গীতা ৪/১৩]

অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি (প্রচলন) করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

“ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ।

কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈ।।”

[ভগবান শ্রীকৃষ্ণঃ গীতা ১৮/৪১]

অনুবাদঃ “হে পরন্তপ! স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।”

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা দেখতে পায়, ভগবান মানব সমাজে চারটি বর্ণ প্রচলন করেছেন প্রকৃতিজাত ত্রিগুন ও তা থেকে উৎপন্ন কর্ম স্পৃহা অনুসারে। যেমন যারা সর্বদা সত্ত্বগুনের দ্বারা প্রভাবিত তারা ব্রাহ্মন বা সমাজের আধ্যত্মিক শিক্ষক বা বুদ্ধিমান শ্রেণীতে পরিণত হন,আবার যারা রজোগুনের দ্বারা প্রভাবিত তারা ক্ষত্রিয় বা সৈনিক বা দেশ পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। আর যারা রজ ও তম গুনের প্রতি প্রভাবিত তারা বৈশ্য বা ব্যবসায়িক শ্রেণীতে পরিণত হন। তার পরের বর্ণটি হল শ্রমজীবি সম্প্রদায়, এদের বলা হয় শুদ্র এবং এরা তমোগুনের দ্বারা প্রভাবিত।

সুতারাং ভগবান যদি এ মানব সমাজে চতুর্বর্ণ জন্ম অনুসারে প্রচলন করতেন তাহলে তিনি অবশ্যই জন্ম শব্দটি উচ্চারন করতেন। কিন্তু ভগবান মানব সমাজে চতুর্বর্ণ প্রচলনের ইতিহাস হিসেবে দাবী করেছেন গুন ও কর্ম।

জন্ম অনুসারে ভগবান যে চতুর্বর্ণ মানব সমাজে সৃষ্টি করেন নি, এটি আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,ঋগ্বেদ, স্কন্দ পুরান এবং নীতি শাস্ত্রে। সেখানে বলা হয়েছে..

“জন্মনা জায়তে শুদ্রো সংস্কারাদ্দ্বিজ উচ্যতে।”

[স্কন্দ পুরাণ, নাগরখণ্ড ২৩৯/৩১]

অনুবাদঃ “সকল বর্ণে জন্মগ্রহনকারী যেকোন ব্যাক্তি জন্ম থেকে শুদ্র। কিন্তু তিনি যদি বৈদিক শাস্ত্রের নিয়মনীতি অনুসরণ করে উপনয়ন সংস্কার করেন তাহলে তিনি ব্রাহ্মন।

“তে অজ্যেষ্ঠা অকণিষ্ঠাস উদ্ভিদোহমধ্যমাসেঃ মহসা বি বাবৃধুঃ।

সুজাতাসো জনুষঃ পৃশ্নি মাতরা দিবো মর্য্যা আ নো অচ্ছা জিগতন।।”

[ঋগ্বেদ ৫/৫৯/৬]

অনুবাদঃ মানবের মধ্যে কেহ বড় নয় কেহ ছোট নয় এবং কেহ মধ্যম নয়, তাহারা সকলে উন্নতি লাভ করিতেছে। উৎসাহের সহিত বিশেষ ভাবে ক্রমোন্নোতির প্রযত্ন করিতেছে। জন্ম হইতেই তাহারা কুলীন (শুদ্র)। তাহারা জন্মভূমির সন্তান দিব্য মনুষ্য। তাহারা আমার নিকট সত্য পথে আগমন করুক।।

“তজাত্যাব্রাহ্মণশ্রাত্রক্ষত্রিয়োবৈশ্যএবন।

নশূদ্রোনর্চবম্লেচ্ছোভেদিতাগুণকর্মভিঃ।।”

[শুক্রনীতি – ১/৪/৩৮]

অনুবাদ:-“এই জগতে জন্ম দ্বারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, ম্লেচ্ছ হয় না, কিন্তু গুণ এবং কর্মভেদে হয়।”

এ বিষয়ে আরো পরিষ্কার করা হয়েছে রামায়ন শাস্ত্রে। সেখানে বলা হয়েছে, ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্র কঠোর তপস্যা করে (কর্ম ও গুন অনুসারে) ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন।-

“ততঃ সুরগণাঃ সর্বে পিতামহপুরোগমাঃ।।

বিশ্বামিত্রং মহাত্মানং বাক্যং মধুরমব্রুবন্।

ব্রহ্মর্ষে স্বাগতং তেহস্তু তপসা স্ম সুতোষিতাঃ।।

ব্রাহ্মণ্যং তপসোগ্রেণ প্রাপ্তবানসি কৌশিক।”

[বাল্মীকি রামায়ণ,আদিকাণ্ড ৬৫।১৮-২০]

অনুবাদঃ তখন পিতামহ ব্রহ্মাকে পুরোভাগে (সামনে) নিয়ে দেবতারা সকলে মহাত্মা বিশ্বামিত্রকে মধুর বাক্যে বললেন,হে ব্রহ্মর্ষি! আপনাকে স্বাগতম। আপনার তপস্যায় আমরা সকলে সন্তুষ্ট। হে কুশিকনন্দন! তপস্যার দ্বারা আপনি ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।

সুতারাং জন্মগ্রহণ ব্যতীত ব্রাহ্মন,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শুদ্র বর্ণের যেকোন মানুষ যদি তার কর্মকে পরিবর্তন করেন তাহলে তার বর্ণও পরিবর্তন হবে।এ বিষয়ে মনুস্মৃতি এবং শ্রীমদ্ভাগবত পুরান শাস্ত্রে বলা হয়েছে..

“শূদ্রো ব্রাহ্মণতাং এতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্।

ক্ষত্রিয়াজ্জাতং এবং তু বিদ‍্যাদ্বৈশ‍্যাত্তথৈব চ।।”

[মনুস্মৃতিঃ ১০/৬৫]

অনুবাদ:-শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারে, এবং ব্রাহ্মণও শূদ্র হতে পারে। ঠিক এভাবেই ক্ষত্রিয়ও ব্রাহ্মণ ও শূদ্র হতে পারে, অর্থাৎ নিজ বর্ণ হতে বেরিয়ে অন‍্য বর্ণে চলে যেতে পারে।

“যস্য কায়গতং ব্রহ্ম মদ্যেনাপ্পাবতে সকৃৎ।

তস্য ব্যপৈতি ব্রাহ্মণ্যং শূদ্রত্বঞ্চ স গচ্ছতি।।”

[মনুস্মৃতি ১১/৯৮]

অনুবাদঃ যে ব্রাহ্মণের দেহমধ্যস্থিত বেদব্রহ্ম (আত্মা) একবারও মদের দ্বারা সংসৃষ্ট হয় তার ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হ’য়ে যায়, এবং সে ব্যক্তি শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

“যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম।যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তৎ তেনৈব বিনিদিশেৎ।।”

[শ্রীমদ্ভাগবত ৭/১১/৩৫]

অনুবাদঃ যদি কেউ উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মন,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্রের লক্ষণগুলি প্রদর্শন করেন, তাহলেও তাঁকে ভিন্ন বর্ণের বলে মনে হলেও এই লক্ষণ অনুসারে তারঁ বর্ণ নিদিষ্ট হবে।

সুতারাং উপরোক্ত আলোচনায় যেকোন বর্ণের সনাতনী তার গুন ও কর্ম অনুসারে উপনয়ন সংস্কার ও অন্যান্য শাস্ত্রীয় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে ব্রাহ্মন বর্ণে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।একইভাবে ক্ষত্রিয়ও তার কর্ম পরিবর্তন করে বৈশ্য হতে পারবেন। বৈশ্যও তার কর্ম পরির্বতন করে শুদ্র হতে পারবেন। এভাবেই প্রত‍্যেকে তার নিজ নিজ ক্ষমতা অনুসারে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র, এ চারটি বর্ণের মধ্যে যেকোন একটি বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। সুতারাং সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে জন্ম দিয়ে কখনো বর্ণ বিচার হয় না বরং তার কর্ম ও গুণ দিয়েই বর্ণের বিচার নিরুপিত হয়।

 

পোষ্টটি লিখেছেন: নীরব পথিক

নীরব পথিক এই ব্লগে 16 টি পোষ্ট লিখেছেন .