মনের যত কথা

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে।

“মির্চা, মির্চা আই হ্যাভ টোল্ড মাই মাদার দ্যাট ইউ হ্যাভ কিসড মাই ফোরহেড'”

নহন্যতে উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি টি অবশ্যই পাঠকদের মনে আছে? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেম কি শুধুই প্রেম ছিল নাকি সেই সাথে কিছু শরীরের ভালবাসাও ছিল। “লা নুই ব্যাঙ্গলী” তে মির্চা এলিয়াদ কি মৈত্রেয়ী দেবী ও তার সাথে ভালবাসার কথা লিখতে যেয়ে কি কোন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলেন?”লা নুই ব্যাঙ্গলী”প্রকাশের বহু বছর পর মৈত্রেয়ী দেবী তাদের ভালবাসার গল্প নিয়ে লিখেছিলেন ন হন্যতে।

মৈত্রেয়ী দেবীর জন্ম ১৯১৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলায়। তার বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একজন দার্শনিক এবং তৎকালীন বাংলার অন্যতম শিক্ষাবিদ, গবেষক। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট।আর মৈত্রেয়ী দেবীর মায়ের নাম ছিল হিমানী মাধুরী রায়। যদিও তার শৈশব কাটে বরিশালে, পরে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে কৈশোরেই সপরিবারে চলে আসেন কলকাতার ভবানীপুরে।

চয় ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় মৈত্রেয়ী দেবী ছিল মায়ের সবচেয়ে কাছের।

মৈত্রেয়ী এক দিকে ছিলেন ভীষণ সুন্দরী অন্যদিকে বয়সের তুলনায় তার বুদ্ধি, স্বভাব, গাম্ভীর্য ও বিদ্যানুরাগ তাকে তার সমসাময়িক অন্য কিশোরীদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল। জীবনের এই ব্রাহ্মমুহূর্তে সংস্পর্শে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সারাজীবন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গুরুর মতো শ্রদ্ধা করেছেন ভালবেসেছেন। কবি গুরুর কাছেও মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন স্নেহধন্যা।

জীবন চলছিল জীবনের নিয়মে কিন্তু ১৯২৮ সালের একটা ঘটনা তার সারা জীবন কে উথাল পাতাল করে দিয়েছিল। এই বছরে ভারতে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গবেষণা করার উদ্দেশে কলকাতায় আসে ২১ বছরের রোমানিয়ান শ্বেতাঙ্গ যুবক মির্চা এলিয়াদ। মূলত সে এসেছিল (১৯২৮-৩২) ‘নোয়েল এন্ড নোয়েল’ কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ২৫০ টাকা মাসিক বেতনে সে ভারতে চাকুরী করতে। সাথে উদ্দেশ্য ভারতীয় দর্শন নিয়ে গবেষণা করা। তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল মৈত্রেয়ী দেবীদের ভবানীপুরের বাড়িতেই। মৈত্রেয়ী দেবী তখন ১৪ বছরের কিশোরী।

মির্চা এলিয়াদ অনেক আগে থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কলকাতায় এসে সেই অনুরাগ এক অব্যক্ত ভালোবাসায় পরিণত হলো। মির্চা ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিশেষ করে বাংলাকে এক কথায় ভালোবেসে ফেললো। এবং বুঝেছিল বাংলাকে আরও গভীর ভাবে জানতে হলে বাংলা ভাষা শেখা প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই তার আর মৈত্রেয়ী দেবীর বন্ধুত্বের সূত্রপাত। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল এবং উদারমনা। তার নিজের ইচ্ছা ছিল মির্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে মৈত্রেয়ী দেবী শিখবেন রোমানিয়ান জানবেন সেদেশের সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে।

মির্চা ও মৈত্রেয়ীর ভাষা, ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি সবই আলাদা। তারা দুজন কথা বলতেন ইংরেজিতে। প্রায়ই শব্দ খুঁজে না পেয়ে মৈত্রেয়ী দেবীকে ডিকশনারি ঘাঁটতে হতো। তবুও এই সমস্ত বাধাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী পরস্পরের কাছে এলেন। কবিতা, দর্শন, গানের আদান-প্রদানের ভেতর অনেকটা অজান্তেই, তারা করে ফেললেন হৃদয়ের দেয়া নেয়া।

একদিন হঠাৎ মৈত্রেয়ী দেবীদের বাড়ির লাইব্রেরির ঘরে বসে মির্চা এলিয়াদ মৈত্রেয়ী দেবীকে জানিয়ে দিলেন তার প্রতি তার ভালোবাসার কথা, সাথে এও জানালেন – “আমাকে বিয়ে করবে?’’

সহজ সরল মির্চা এলিয়াদ ধরে নিয়েছিল, তার অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে মৈত্রেয়ী দেবীকে প্রার্থনা করলেই তিনি পেয়ে যাবেন, কারণ ছাত্র হিসেবে মির্চা এলিয়াদকে নিয়ে গর্ব ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর বাবার। কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের গোঁড়ামি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না মির্চার।

এর মধ্যেই মৈত্রেয়ী দেবীর বোন চিত্রিতা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় প্রতিদিন চিত্রিতাকে নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে বেরোন। সাথে থাকে মির্চা। কিন্তু সদ্য কিশোরী চিত্রিতার চোখে মৈত্রেয়ী দেবী আর মির্চা এলিয়াদের সম্পর্ক যেন অদ্ভুত ঠেকল । বাড়ি ফিরে তার মাকে বলে দিল সমস্ত ঘটনা।

মৈত্রেয়ী দেবীর ব্যক্তিত্বময়ী মা চিৎকার চেঁচামেচির রাস্তায় গেলেন না। রাত্রে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে জানতে চাইলেন, – “তুমি কি মির্চাকে বিয়ে করতে চাও?”

মৈত্রেয়ী কান্না জর্জরিত কণ্ঠে তার মাকে বলেছিল, “হ্যাঁ, চাই, আমি ওকে ভালোবাসি।”

কিন্তু নিয়তি যেন অন্যকথা লিখে রেখেছিল।

পরদিন সকালেই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যে ভালোবাসা আর সম্মান নিয়ে মির্চাকে এ বাড়িতে এনেছিলেন, ঠিক ততটাই অসম্মান আর ঘৃণা নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

যাওয়ার সময় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মির্চা একবার শেষ দেখা পেয়েছিল মৈত্রেয়ীর। মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোর করে ‘নমস্কার’ জানিয়েছিল সে। মৈত্রেয়ীর দু’চোখ ভেঙে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। সেটাই ছিল মির্চা ও মৈত্রেয়ীর এক প্রকার শেষ দেখা।সেটা ছিল ১৯৩০ সালের এক সকাল।

সেই সময় মৈত্রেয়ী দেবী আবার শরণাপন্ন হলেন রবীন্দ্রনাথের। আবার পড়াশুনায় মন বসল। সঙ্গে যুক্ত হল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উদ্দীপনা।একি সাথে

আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর অতুল প্রসাদের গানে। ১৯৩২ সালে অতুলপ্রসাদের কথায় ও সুরে “মধুকালে এল হোলি” গান মৈত্রেয়ী দেবির গলায় এইচ এম ভি থেকে রেকর্ড হয়ে বেরলো।

১৯৩৪ সালে বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে গেল কালিম্পংয়ে কাছে মংপুর বিখ্যাত সিঙ্কোনা প্যান্টের চিফ কেমিস্ট ডাঃ মনমোহন সেনের সাথে। তখন ডাঃ মনমোহন চৌত্রিশ আর মৈত্রেয়ী দেবী কুড়িতে।

১৯৩৬ সালে মৈত্রেয়ী দেবী দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক হলেন যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে।

তারপর পাকাপাকি ভাবে মংপুতে। স্বামী ছিলেন বয়সে অনেক বড় তবুও ভালোবাসা কোনও বাঁধা হল না। মানুষ হিসেবে মৈত্রেয়ীর স্বামী এত সহজ সরল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন যে, মৈত্রেয়ী জীবনকে আবার ভালোবাসতে শিখে গেলেন। মৈত্রেয়ী দেবী জীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলেন।

মৈত্রেয়ী দেবী ততদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আরও নতুন ভাবে চিনেছেন। তার আর তার স্বামীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ এই দুই বছরে কবি চারবার মংপু থেকে ঘুরে গেছেন। যার স্মৃতি থেকে তিনি পরবর্তীকালে লিখেছে “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” (১৯৪২)।

ওদিকে মির্চা এলিয়াদ সেই ঘটনার কিছুদিন পর ভারতবর্ষ ত্যাগ করে ফিরে গেলেন দেশে। এবং আরও বেশী করে গবেষণা, লেখাপড়ার মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিলেন। কিন্তু মৈত্রেয়ীর সাথে সম্পর্কের যে দুঃখজনক পরিণতি মির্চার হয়েছিল, সেই গভীর বেদনা আর ক্ষতকে একা বয়ে নিতে পারছিলেন না বলেই হয়তো, ১৯৩৩ সালে কলকাতা থেকে যাওয়ার তিন বছর পর রোমান ভাষায় লিখে ফেললেন কালজয়ী উপন্যাস “লা নুই বেঙ্গলি” যা বাংলা করলে দাঁড়ায় “বাংলার রাত”।

এই একটি উপন্যাস মির্চা এলিয়াদকে তার দেশে ঔপন্যাসিক হিসেবে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিল। এটি ছিল সেই সময়ের রোমানিয়ান ভাষায় লেখা বেস্ট সেলার। “লা নুই বেঙ্গলী” কখনই আত্মজীবনী ছিল না। মির্চা এলিয়াদ তাতে মিশিয়েছিলেন কল্পনার আবেশ। আর সেই কল্পনার অনেকটা জুড়েই ছিল দুজনের শারীরিক ভালোবাসাা। সে দেশের সংস্কৃতিতে সেটা হয়তো কিছুই নয় কিন্তু ভারতবর্ষের চোখে সেটা অশ্লীল ছাড়া আর কিছু নয়।

মজার ব্যপার হল হলো, মির্চা এলিয়াদ যে মৈত্রেয়ী দেবীকে তার উপন্যাসে স্বপ্নের নায়িকা বানিয়েছে, সেই খবর মৈত্রেয়ী দেবী জানতেন না। যখন জানলেন তখন তার বয়স প্রায় ষাটের কোটায়। তিনি তখন বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে দিকে দিকে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তখন তার ছেলে ও মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে ও তাদের নিজেদের সন্তান আছে।

মৈত্রেয়ী পড়লেন “না লুই বেঙ্গলী” আবিস্কার করলেন কিভাবে তার পবিত্র প্রেমকে উপন্যাসে নায়িকা হিসেবে তার নাম রেখে দুজনের সম্পর্ককে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে সেটা অশ্লীলতার এক চরম নিদর্শন।

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে। পুরনো প্রেম নিয়ে এলো নতুন করে কষ্ট নিয়ে। এরই মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর সুযোগ এলো শিকাগো সফরের। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। মির্চা এলিয়াদ তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।

মৈত্রেয়ী দেবী তার স্বামীকে জানালেন সেকথা।তিনি সাহস জোগালেন মির্চার সাথে দেখা করার। লোকলজ্জার ভয় তুচ্ছ করে মৈত্রেয়ী তার স্বামীর অনুমতি নিয়েই দেখা করতে গেলেন জীবনের প্রথম ভালোবাসার সাথে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরির এক কোনে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আবার দেখা হল মির্চা আর মৈত্রেয়ীর।

শিকাগো থেকে ফিরে “লা নুই বেঙ্গলি”র সমস্ত অসত্য ঘটনার উত্তরে ও একইসাথে নিজের মনের গভীরে এত বছর ধরে গোপন করে রাখা এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে মৈত্রেয়ী লিখে ফেললেন বাংলা ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ট এক উপন্যাস “ন হন্যতে”।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হল “ন হন্যতে”। আবার জীবনে ঝড় উঠল মৈত্রেয়ী দেবীর এতদিনের সাজানো গোছানো জীবনে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার সঞ্চার হল। সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজে একজন বিবাহিত বৃদ্ধ নারীর তার অল্প বয়েসের প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা লেখাকে কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু মৈত্রেয়ী দেবী তার ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ‘ন হন্যতে’ এর অর্থ, যার মৃত্যু নেই। প্রেম ও আত্মার অবিনশ্বরতাকে এক করে মৈত্রেয়ী তার ও মির্চার ভালোবাসার সত্যকে নির্ভীকভাবে মানুষের সামনে তুলে আনেন। এই সত্যভাষণ তাঁকে এনে দেয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৭৬)। বলা হল আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত একালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ১৯৭৭ সালে পেলেন পদ্মশ্রী।

শিকাগোতে মির্চা এলিয়াদের সাথে দেখা হওয়ার পর মৈত্রেয়ী দেবী তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন ওরকম মিথ্যে লিখেছিলেন তার ব্যাপারে। উত্তরে মির্চা বলেছিলেন, ভেতর ভেতর নিদারুণ কষ্টে গুমরে মরছিলেন তিনি; কল্পনার কাছে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ-ই অবশিষ্ট ছিল না তার।

তিনি মৈত্রেয়ী দেবীকে কথাও দিয়েছিলেন, মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনকালে এই বই কোনোদিন ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে না। ১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী মৈত্রেয়ী দেবী মারা যান তার ৪ বছর পর ১৯৯৪ সালে “ন হন্যতে” ও “লা নুই বেঙ্গলি” দুটো বই ই একসাথে শিকাগো প্রেস থেকে ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয় “ন হন্যতের” ইংরেজী অনুবাদের নাম ছিল “ইট ডাজ নট ডাই”।

মৈত্রেয়ী দেবী আর মির্চা এলিয়াদের ভালবাসার ভালোবাসা আজ সাহিত্যের ভান্ডারে স্থায়ী ভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

পোষ্টটি লিখেছেন: নীরব পথিক

নীরব পথিক এই ব্লগে 16 টি পোষ্ট লিখেছেন .