সধবা নারীরা একাদশী ব্রত পালন করলে কমে যাবে স্বামীর আয়ু,একাদশী শুধুমাত্র বিধবা নারীদের জন্য, সত্যি কি তাই???
আজকাল অনেক তথাকথিত পন্ডিত বা কিছু ব্যক্তি নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে প্রচার করছেন যে বৈদিক শাস্ত্রে নাকি সধবা নারীর একাদশী ব্রত পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।।।
এটা শুধুই আজকালকার ঘটনা নয়। বাঙালিদের মাঝে এই কুসংস্কার দীর্ঘ সময় ধরে লালিত হয়ে আসছে, যা পুরনো সময়ের (কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমানেও) চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালগুলোতেও আমরা প্রতিফলিত হতে দেখেছি।।। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ প্রহসনের শিরোনামও এইদিকেই নির্দেশ করে যে আমাদের সমাজে তখনকার সময়ে এবং বর্তমান যুগেও অনেকেই এটা বিশ্বাস করে যে একাদশী ব্রত বিধবা নারীদের জীবনচর্চার একটি অংশ, যা সধবা নারীরা পালন করে না।।। কিন্তু এটি কোন শাস্ত্রসিদ্ধান্ত নয়।।। বরং শাস্ত্রে বহুস্থানে সধবা নারীকে তার পতিসহ একাদশী ব্রত পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।।।
মোক্ষদং কূর্ব্বতাং ভক্ত্যা বিষ্ণো:প্রিয়তরং দ্বিজাঃ।।
~ [ বৃহন্নারদীয় পুরাণ, ২১।২ ]
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শুদ্র এবং বিবাহিত স্ত্রীলোক – ইহাদিগের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি হউক, ভক্তি পূর্ব্বক একাদশী ব্রত পালন করে মুক্তি লাভ করতে পারে।।।
সুপুত্ৰা স্বামিসুভগা যাতি প্রেত্য হরের্গৃহম॥ ৭৬
যো যচ্ছতি হরেরগ্রে প্রদীপং ভক্তিভাবতঃ।
হরের্দিনে দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুণ্যসঙ্গ্যা ন বিদ্যতে ॥৭৭
যাঙ্গনা ভর্ত্তৃসহিতা কুরুতে জাগরং হরেঃ।
হরের্নিকেতনে তিষ্ঠেচ্চিরং পত্যা সহ দ্বিজ ॥৭৮
~ [ পদ্মপুরাণ, স্বর্গখন্ড, ৪৪।৭৬-৭৮ ]
বঙ্গানুবাদ: যে স্ত্রী পতি সহ একাদশীব্রত করে, সে সুপুত্রা স্বামি-সুভাগা হয়, মরণান্তে হরিগৃহ বৈকুন্ঠে যায়।।। দ্বিজ শ্রেষ্ঠ! একাদশীতে ভক্তিভাবে যে জন হরির অগ্রে প্রদীপ দান করে, তাহার পুণ্যের সংখ্যা নাই অর্থাৎ অগণিত পুণ্য লাভ করে।।। আর যে স্ত্রী স্বামীর সহিত একাদশীতে রাত্রি জাগরণ করে, সে চিত্রকাল পতি সহ হরির নিকেতনে বাস করে।।।
সুপুত্রা ভর্ত্তসুভগা ভবেৎ সা প্রতিজন্মানি।।
~ [ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ৫।১৯ ]
বঙ্গানুবাদ: যে নারী স্বামীর সাথে একাদশীব্রত করে, সে জন্মে জন্মে সপুত্রা ও স্বামীসুভগা হয়।।।
সুপ্ৰজা স্বামিসুভগা সা ভবেৎ প্রতিজন্মনি।
স্বামিনা সহ যা নারী কুরুতে জাগরং হরেঃ।
সা তিষ্ঠেদ্বিষ্ণুভবনে চিরং ভর্ত্রা সহ দ্বিজ ।।
~ [ পদ্মপুরাণ, ক্রিয়াযোগসারঃ ২২।১০৫ ]
বঙ্গানুবাদ: যে নারী স্বামীর সাথে একাদশীব্রত করে, সে জন্মে জন্মে সুপুত্রা ও স্বামীসুভগা হয়।।। আর যে নারী স্বামীর সঙ্গে জাগরানুষ্ঠান করে, সে স্বামীর সাথে সুচিরকাল বৈকুন্ঠধামে অবস্থান করে।।।
লোকানাঞ্চৈব সর্ব্বোষাং ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী।।
~ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৪৮।৪ ]
বঙ্গানুবাদ: কোন দুর্ভাগা স্ত্রী যদি একাদশী ব্রত আচরণ করেন, তিনি সৌভাগ্য লাভ করেন।। এই একাদশী ব্রত সর্বলোকের ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী, সর্ব্বপাপহারিণী ও গর্ভবাসনিবারিণী।।
একাদশ্যামুপবসেৎ পক্ষয়োরভয়োরপি ॥
~ [ বিষ্ণুধর্মোত্তর, হরিভক্তিবিলাস, ১২।৪৭ ]
বঙ্গানুবাদ: পুত্র, ভার্যা (পত্নী) ও স্বজনবর্গের সহিত ভক্তিযুক্ত হয়ে উভয়পক্ষের একাদশীতে উপবাস কর্তব্য।।
যুক্তঃ সংবৎসরং বীরো দধার দ্বাদশীব্রতম্ ॥
~ [ শ্রীমদ্ভাগবতম্ ৯।৪।২৯ ]
বঙ্গানুবাদ: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করার জন্য অম্বরীষ মহারাজ তারই মতো গুণবতী স্ত্রী সহ এক বৎসর কাল যাবৎ একাদশী এবং দ্বাদশীব্রত পালন করেছিলেন।।।
একাদশীব্রতং সম্যক সেবনং কার্ত্তিককস্য চ।।
~ [ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, কার্ত্তিকমাসমাহাত্ম্যম্, ১৩।১২ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামাকে বললেন, ‘চন্দ্রের পত্নী গুণবতী জন্ম হইতে মরণ পর্য্যন্ত একাদশী ব্রত ও কার্ত্তিক মাস ব্রত – এ দুই ব্রত সম্যকরূপে আচরণ করেছিলেন।।।
ইতি রাধামুখাচ্ছুত্বা যজ্ঞসীতাশ্চ গোপিকাঃ।
একাদশীব্রত চক্রবিধিবৎ কৃষ্ণলালসাঃ।।২৩
একাদশীদিনেনাপি প্রসন্নঃ শ্রীহরিঃ স্বয়ম।
মার্গশীর্ষে পূর্ণিমায়াং রাসং তাতিশ্চকার হ।।২৪
~ [ গর্গসংহিতা, মাধুর্য্যখন্ড, ৯।২৩-২৪, নারদ উক্তি ]
বঙ্গানুবাদ: নারদ বলিলেন,”যজ্ঞসীতা গোপীগণ রাধার মুখে একাদশী মাহাত্ম্য শুণে কৃষ্ণপ্রাপ্তির জন্য যথাবিধি একাদশী ব্রত করেন ; তাঁদের একাদশী ব্রত ফলে স্বয়ং গোপবালক হরি প্রসন্ন হয়ে অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমায় তাঁহাদের সহিত রাসনৃত্য করেছিলেন।।।”
শৃণু রাজন যথা বৃত্তং দৃষ্টং তৎকথয়ামি তে ।
মর্ত্যলােকে পুরা হাসীদব্ৰাহ্মণ্যেকা চ ভারত
ব্রতচৰ্য্যারুতা নিত্যং দেবপূজারতা সদা। ২৩
মাসোপবাসনিরতা মম ভক্তা চ সৰ্ব্বদা।
কৃষ্ণোপবাসসংযুক্তা মম পূজাপরায়ণ।। ২৪
~ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৪২।২২-২৪ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন,–রাজন! শ্রবণ করুন, বৃত্তান্ত বলিতেছি- হে পার্থিব যুধিষ্ঠির!!! পুরাকালে মর্ত্যলোকে ব্রতচর্য্যানিরতা, নিত্য
দেবপূজা পরায়ণ এক ব্রাহ্মণী ছিলেন। তিনি আমার নিত্যভক্তা, মাসােপবাসে নিয়তা, কৃষ্ণপ্রীত্যৰ্থ উপবাস পরায়ণা এবং মদীয় পূজায় একান্ত অনুরক্তা।।
মানুষ্যা সত্যব্রতয়া ভুক্তিমুক্তিফলপ্রদম।
রূপকান্তিসমাযুক্তা ক্ষণেন সমবাপ সা॥ ৪৬
ধনং ধান্যঞ্চ বস্ত্রাদি সুবর্ণং রৌপ্যমেব চ।
ভবনং সর্বসম্পন্ং ষটতিলায়াঃ প্রভাবতঃ ॥৪৭
~ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৪২।৪৫-৪৭ ]
এমন আরও অনেক শাস্ত্রীয় রেফারেন্স আছে, বাস্তবে যা অপপ্রচার হচ্ছে সেটা সম্পুর্ন মিথ্যা এবং বানানো মতবাদ তাদের।।