মনের যত কথা

বেদ এবং গীতার দু-তিনটি তথ্যসূত্র দিয়ে অনেকে প্রচার করছে সনাতন ধর্মে মূর্তিপূজা নাই। এই তথ্যের সত্যতা দেখা যাক।

এটি ঠিক যে, বেদে মূর্তি/প্রতিমা পূজা নাই। যজুর্বেদে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ঈশ্বর নিরাকার এবং তাঁর প্রতিমা হয় না (৩২/৩)। যেহেতু গীতা সেই বেদেরই জ্ঞান, তাই স্বাভাবিকভাবেই গীতাতেও প্রতিমাপ্রসঙ্গ নাই। কিন্তু কাটমোল্লারা বলছে যে, গীতাতে দেবতার মূর্তি পূজা করা নিষেধ। এই বিষয়ে তারা গীতার ৭ম অধ্যায়ের ২০তম শ্লোকটির উল্লেখ করে থাকেন। মজার বিষয় হলো, গীতাতে মূর্তি বা প্রতিমা পূজার কোনো প্রসঙ্গই নাই। উক্ত শ্লোকের অর্থ সহজ কথায় এরকম যে, যারা ফলের কামনা করে তারা অন্য দেবতা ভজনা করে (কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেঽন্যদেবতাঃ)। লক্ষ্য করুন, এখানে নিষেধাজ্ঞা নাই, গীতার বক্তব্যের অর্থ হলো, ফলের কামনা করে অন্য দেবতার ভজনা করলে ফল আসলেও মুক্তি আসবে না, মুক্তির জন্য সেই এক ঈশ্বরের ভজনা করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই শ্লোক কাটমোল্লাদের এত প্রিয় কেন? কিংবা ঈশ্বরের মূর্তি নাই-এই তথ্য তারা প্রচার করে কী শান্তি পায়? এগুলোর উত্তর শেষে দিচ্ছি। তার আগে সনাতন ধর্মশাস্ত্র থেকে প্রতিমাপূজার ব্যপারাটা ক্লিয়ার করি।

আমরা উপরে দেখলাম যে, বেদ ও গীতায় প্রতিমাপূজা নাই। তাহলে এই প্রতিমাপূজা আসলো কোথা থেকে? মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী নির্বেদানন্দ, ড. দুর্গাদাস বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু ইত্যাদি গবেষকগণ বলেছেন, “দেবমূর্তি আচার্যদের কল্পনা।” এই বিষয়ে শাস্ত্র কী বলছে দেখি…

  • রামপূর্বতাপনীয়োপনিষদ বলছে-উপাসকগণের ধ্যানের নিমিত্ত নিত্যচৈতন্যস্বরূপ অমূর্ত ব্রহ্মের রূপকল্পনা হয়েছে (১/৭)।
  • শ্রীসদাশিব বললেন- “উপাসকদের কার্যসিদ্ধির নিমিত্তই গুণ ও ক্রিয়া অনুসারে দেবীর রূপ কল্পনা করা হয়েছে। বাস্তবিক তাঁর কোনো রূপ নাই। …যোগরূঢ় মহাত্মারা সেই নির্গুণা নিরাকার কালশক্তির বর্ণ নিরূপণ করেছেন। …এইরূপে সমগ্র রূপ পরিকল্পিত হয়েছে।” (মহানির্বাণতন্ত্রম্: ১৩/৪-১০)।

অর্থাৎ বেদের নিরাকার ব্রহ্মকেই উপাসকগণ বিভিন্ন কর্যসিদ্ধির জন্য ব্রহ্মের সেই গুণ ও ক্রিয়া অনুসারে মূর্তরূপে কল্পনা করে নিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, এই মূর্তিতে ঈশ্বরের উপাসনা ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখ আছে? আসুন বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের শাস্ত্রগুলো দেখি…

  • সেই নির্গুণ ব্রহ্মকে যখন কোনো প্রতিকৃতির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো, তখন কোনো চেহারা সদৃশ প্রতিমা নির্মাণ হয়নি, নির্মিত হলো লিঙ্গ। সেটিকে আমরা শিবলিঙ্গ বা শিবের প্রতিকৃতি বলি। ‘শিব’ ঈশ্বরেরই মঙ্গলময় নাম। এই শিবলিঙ্গ কী প্রকারে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, লক্ষণ কীরূপ হবে, কীরূপে পূজা হবে ইত্যাদি সমস্ত বিষয় বর্ণিত হয়েছে শিবপুরাণে। মৃত্তিকা, শিলা, কিংবা লোহা দ্বারা এই শিবলিঙ্গ নির্মাণ করা যেতে পারে (শিবপুরাণ‌: বিদ্যেশ্বরসংহিতা/অধ্যায়: ৯)।
  • বরাহ পুরাণ বলছে- যে দ্রব্যের প্রতিমা প্রস্তুত করতে হবে, তা নিয়ে এসে শাস্ত্রোক্ত বিধিমতো প্রতিমা নির্মাণ করবে। পরে যথাবিধি অর্চনা করে প্রতিমাকে প্রতিষ্ঠাপূর্বক ফল কামনায় পূজা করবে (১৮১/৮-১০)। দেবতা মৃন্ময়ী প্রতিমাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পূজা গ্রহণ করেন (১৮৩/১)। শিলা, তামা, কাসা, রূপা, সীসা দ্বারা দেবমূর্তি নির্মাণ করা যাবে (১৮৩/৪-৫)। বরাহ পুরাণের ১৮১-১৮৬ অধ্যায় (মোট ৬টি অধ্যায়) বিভিন্ন প্রতিমা স্থাপনের বিধি বর্ণিত হয়েছে।
  • মৃত্তিকা দ্বারা প্রতিমা নির্মাণ করে বিল্বপত্র দ্বারা দেবতার পূজা করলে অপার পুণ্যলাভ (শ্রীমহাভাগবতম্: ৮১/২৩)।
  • প্রতিমা কোন দিকে স্থাপিত হবে তা বর্ণিত হয়েছে অগ্নিপুরাণের ৪৩ অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে, মৃন্ময়ী, দারুময়ী, লোহময়ী, রত্নময়ী, শৈলময়ী, গন্ধময়ী ও কুসুমময়ী-এই সাতপ্রকার প্রতিমা শাস্ত্রে নির্দিষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে মৃন্ময়ী, গন্ধময়ী ও কুসুমময়ী প্রতিমা পূজা করলে সর্বকামনা ফলপ্রদ হয়ে থাকে (৪৩/১-১০)। অগ্নিপুরাণের ৪৭ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে শালগ্রামাদির পূজাবিধি। উত্তম, মধ্যম ও অধম পূজাও বর্ণিত হয়েছে এই অধ্যায়েই। মূর্তিপূজাকে মধ্যম স্তরে রাখা হয়েছে।
  • শিলা, মৃত্তিকা, দারু ও লোহাদি দ্বারা বিষ্ণুর মূর্তি প্রস্তুত করে শ্রৌত, স্মার্ত ও আগমোক্ত বিধানে পূজার উল্লেখ আছে পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে (২৫৩/৬)।
  • কালিকা পুরাণ বলছে- অনেক জাতীয় পুষ্পদ্বারা দেবীমূর্তির পূজা করবে। মহাষ্টমী ও মহানবমীতে পূজা করে দশমীতে দেবীমূর্তির বিসর্জন করবে (৬১/১৪-১৭)। এই সমগ্র অধ্যায় ও তার পরবর্তী দুই অধ্যায়ে দেবীর মূর্তি ও রূপের কথা আছে।
  • দেবীপুরাণে পরশুরাম দেবী ভগবতীর বিভিন্ন মূর্তির পরিচয় ও সেসকল মূর্তির অর্চনার কথা বলেছেন (৪৪/৯-১২)। এই পুরাণে মনু বলছে – স্বর্ণময়ী, রজতময়ী, তাম্রময়ী, কাষ্ঠময়ী, মৃণ্ময়ী, চিত্রময়ী অথবা রত্নময়ী সুলক্ষণসম্পন্না দেবীমূর্তির নির্মাণ করবে (৫৭/৬)।
  • দেবী পুরাণের ৬০তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়, পৃথুরাজ মৈনাক পর্বতে উমা ও শঙ্করের পূজা করেছিলেন, রঘু কৈলাস পর্বতে অর্ধনারীশ্বর মূর্তির পূজা করেছিলেন এবং দিলীপ কামিকাচলে ত্রিমূর্তির পূজা করেছিলেন (২৫-৩০)।
  • দেবী পুরাণের ৬২তম অধ্যায়ে কোন মাসে কোন ফুল দ্বারা দেবীমূর্তির পূজা করলে অভীষ্ট লাভ হয় তা বর্ণিত হয়েছে। ৬৫তম অধ্যায়ে চিত্রপট দ্বারা পূজার উল্লেখ হয়েছে (১-৩)। এই পুরাণের সমগ্র ৬৭তম অধ্যায়ের প্রতিমাদি পূজার ফল বর্ণিত হয়েছে এবং সমগ্র ১১৮তম অধ্যায়ে মূর্তির জীর্ণতা সংস্কার বিষয়ক আলোচনা রয়েছে।
  • মহানির্বাণতন্ত্র বলছে- মৃত্তিকা, দারু, ধাতু ইত্যাদি দ্বারা দেবতার প্রতিমা নির্মাণ করলে দেবলোক, স্বর্গলোক ইত্যাদি প্রাপ্তি হবে (১৩/২২)।
  • দুর্গা-শিব-গণাদির পূজা, আসন পূজা, বাস্তুপূজা, মন্দির নির্মাণবিধিসহ প্রায় শতাধিক প্রতিমার পূজাপার্বণদির বিধি ও মাহাত্ম্য আছে সমগ্র গরুড় পুরাণে। তাই নির্দিষ্ট করে দু-একটি তথ্যসূত্র দেওয়া গেল না।

পুরাণাদি ছাড়াও স্মৃতিশাস্ত্রে প্রতিমা পূজার উল্লেখ রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আবাহন বা পূজার বিধিতে কোথাও কোথাও বেদমন্ত্রের ব্যবহারও রয়েছে (বিষ্ণু সংহিতা: ৬৫/১-৩, শতাতপ সংহিতা: ২/২২-২৩, ৫/১৭-১৮ ইত্যাদি)।

সুতরাং আমরা দেখলাম যে, বেদ ও গীতায় প্রতিমাপূজার উল্লেখ না থাকলেও পুরাণ, তন্ত্র, স্মৃতি শাস্ত্রে প্রতিমাদি দ্বারা ঈশ্বরের অর্চনা স্পষ্টই রয়েছে। এখন আপনি যদি শুধু বেদানুসারে নিরাকার ঈশ্বরের ভজনা করেন তবে প্রতিমাদির মাধ্যমে পূজার্চনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রতিমাদিতে অর্চনা করছে তাকে এটা বলা যাবে না যে, সনাতন ধর্মশাস্ত্রে প্রতিমাপূজা নাই। পুরাণ, তন্ত্র ও স্মৃতি শাস্ত্রও সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের মর্যাদা পেয়েছে। সুতরাং এসব গ্রন্থের যেসকল বিষয় পালন করলে মানুষ ধর্মের অষ্টেপৃষ্ঠে মিশে থাকবে সেগুলো পালনে বাধা নাই। প্রতিমাপূজা ঠিক না কি ভুল সেটা বিচার-বিবেচনা করবে সনাতন ধর্মগুরুগণ, কাটমোল্লাদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, সনাতন ধর্মশাস্ত্রে প্রতিমাপূজার উল্লেখ নাই-এমন কথা বলা যায় না।

এবার আসুন প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই। অনেকে এগুলো প্রচার করে কী শান্তি পায়? সম্ভবত তাদের ধারণা, যেহেতু বেদ ও গীতায় প্রতিমাপূজা নাই এবং তাদের ধর্মমতেও প্রতিমাপূজা নাই, তাই বেদ ও গীতার তথ্যসূত্র দেখিয়ে সাধারণ হিন্দুদের মগজ ধোলাই করে কোনোভাবে এটি প্রমাণ করার চেষ্টা যে, ঈশ্বর আর আল্লাহ্ একই কিংবা উভয়েই নিরাকার। এখানে মজার একটা তথ্য দেই। ঈশ্বরের কনসেপ্ট আর আল্লাহ্’র কনসেপ্ট এক নয়। বেদে ঈশ্বর নিরাকার এবং সেই ঈশ্বরকে উপাসকগণ গুণ ও ক্রিয়া অনুসারে মূর্তরূপে কল্পনা করে নিয়েছেন। কিন্তু বস্তুত তিনি নিরাকার ও সর্বব্যাপক। কিন্তু ইসলামিক গবেষকদের মতে আল্লাহ্ নিরাকার নয়, সাকার। আল্লাহ্’র সাকার তত্ত্ব কল্পিত নয়, তিনি সাকারই এবং তারা এটিও বলেছেন যে, আল্লাহ্ নিরাকার-এই মতবাদ হিন্দু ধর্ম থেকে নেওয়া (সূত্র: সহীহ বুখারী: তাওহীদ পাবলিকেশন নম্বর: ৪৮১১, টীকাদ্রষ্টব্য)।

আশাকরি প্রতিমাপূজা বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর হলো।

পোষ্টটি লিখেছেন: নীরব পথিক

নীরব পথিক এই ব্লগে 21 টি পোষ্ট লিখেছেন .